অফিস থেকে বাসায় ফিরে সবে ফ্রেশ হব, ঠিক এমন
সময় আব্বুর ফোন। সংক্ষেপে যা বললেন তা হল, ২ লাখ টাকা নিয়ে পঞ্চগড় যেতে হবে এখুনি
কারন ব্যাংক বন্ধ তিনদিন যাবত, এবং টাকাটা খুবই জরুরী। কি আর করা, ঝটপট রেডি হয়ে রওয়ানা
হয়ে গেলাম কল্যাণপুর বাস ষ্টেশন দিকে। প্রচণ্ড জ্যাম ঠেলে কল্যাণপুর পৌঁছুতে রাত
১০ টা বেজে গেল। ১০.৩০ টা এর লাস্ট ট্রিপ এর টিকিট ম্যানেজ করলাম প্রায় ২০ মিনিট
চেষ্টা করে। হানিফ এন্টারপ্রাইজের ওয়েটিং রুমে বসে আছি, বাস আসতে নাকি একটু দেরি
হবে। ওয়েটিং রুমে সবাই আই. পি. এল. দেখছিল। এমনিতেই আমার খেলা দেখতে তেমন ভালো
লাগে না, তাই চেয়ারে হেলান দিয়ে একটু রিলাক্স করার চেষ্টা করছিলাম। হটাত করেই কানে
হালকা ভাবে হারমোনিয়াম এবং ঢোল এর আওয়াজ ভেসে এলো। হয়ত কোন টিভির শব্দ ভেবে এড়িয়ে
গেলাম। ঠিক তখনি আবার শব্দটা একদম কাছ থেকে পেলাম। অনিচ্ছা সত্তেও চেয়ার ছেড়ে শব্দের উৎস খুঁজতে লাগলাম,
এবং পেয়েও গেলাম। হানিফ কাউন্টারের পাশেই একটা বাদ্যযন্ত্রের দোকানে গানের আসর
বসেছিল। সেখানে বসে কিছুক্ষন গান শুনলাম। এর মধ্যেই আমার গাড়ি চলে এলো। গাড়িতে চড়ে
বসলাম পঞ্চগড়ের উদ্দেশে।
পরদিন, অর্থাৎ
৬ তারিখ সকাল ১০ টায় পঞ্চগড় পৌঁছে গেলাম। আব্বুর সাথে দেখা করে তাকে টাকা বুঝিয়ে
দিয়ে খবিরুল ভাই কে ফোন দিলাম। খবিরুল ভাই পঞ্চগড়ের স্থানীয় ছেলে, আমারই বয়সী,
আব্বুর মাধ্যমেই পরিচয়। উনি সেখানে টম্যাটো (স্থানীয়রা বলে হাইব্রিড), বোরো ধান
(স্থানীয় নাম চায়না), ভুট্টা এবং তরমুজের চাষ করেন। উনার সাথে সাইকেলে উনাদের বাড়ি
যাওয়ার পথে কিছু এলাকার নাম খুব ভালো লাগলো। যেমন পানি মাছ পুকুর, আম কাঁঠাল, হাড়ি
ভাসা ইত্যাদি। উনাদের বাড়ি ঠেকুর পাড়া এলাকায়। বাড়ি পৌঁছে কুয়ার পানিতে গোসল করে
ফ্রেশ হয়ে নিলাম। কুয়ার পানি এতো ঠাণ্ডা আর গোসল করতে বেশ ভালো লাগে। গোসল এবং
খাওয়া দাওয়া করে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। ঘুম থেকে উঠে দেখি বিকাল হয়ে গেছে। দ্রুত হাতমুখ
ধুয়ে নাস্তা সেরে ভ্যানে করে পঞ্চগড়ের উল্লেখযোগ্য স্থানগুলো ঘুরে দেখার জন্য
বেড়িয়ে পড়লাম। প্রথমেই আমরা গেলাম টুনির হাট। সেখানে খবিরুল ভাইয়ের শশুর বাড়ি।
সেখান থেকে চলে গেলাম মডেল হাট, সেখান থেকে মহারাজা দীঘি। আমার জীবনে আমি এতবড়
দীঘি দেখিনি। প্রায় ৫৩.৭৯ একরের উপর এই দীঘি। এই দীঘি জিনি খনন করেন উনাকে বলা হত
মহারাজা বা পৃথ্বী রাজ। কথিত আছে যে, “কীচক” নামক এক নিম্নজাতের আক্রমণে উনি
পরাজিত হন এবং ধরা পরার ভয়ে এই দীঘিতেই আত্মহত্যা করেন। দীঘির পানি এতো ঝকঝকে আর
পরিষ্কার যে দেখলেই নেমে পড়তে ইচ্ছে করে। আর এই গরমের দিন হলে তো কথাই নাই। দীঘিতে
প্রচুর মাছ আছে। কিন্তু ধরতে গেলে টাকার বিনিময়ে টোকেন নিতে হয়। ঘণ্টা প্রতি ৩০০
থেকে ৫০০ টাকা। তারপরও ধরতে হবে ছিপ দিয়ে।
দীঘি দেখে হাড়ি
ভাসা ফিরতে গিয়ে জানলাম যে, আমাদের পৌছুতে ১.৩০ ঘণ্টা লাগবে। কিন্তু পথেই আছে
ছিটমহল। ওটার ভেতর দিয়ে গেলে আধঘণ্টায়ই পৌঁছে যাওয়া যেত। ছিট মহলের ভিতর দিয়ে
প্রায় ১.৫ কিলো যেতে হবে। কিন্তু ঐ এলাকা ভালো নয়, দিনে দুপুরে মানুষ খুন হয়। আর
এখন তো রাত। যাই হোক, আমরা রাতে আরেক বাসায় দাওয়াত খেয়ে খবিরুল ভাই দের বাড়িতে
ফিরলাম অনেক রাতে। এই সারা পথে আমাদের সাথে ছিল ভ্যান চালক মুসা। অর বয়স খুব বেশি
না। এই ১৬-১৭ হবে। কিন্তু অর স্ট্যামিনা ছিল অসাধারণ। প্যারালাইজড মা আর ওকে আলাদা
করে দিয়ে ওর বাবা আরেকটা বিয়ে করেছে। ও এই ভ্যান চালিয়েই ওর মাকে নিয়ে জীবনযাপন
করে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় যে, এই বিষয়ে ওর মনে কন কষ্ট নেই। ওকে সারাক্ষন দেখেছি
খুব হাসি খুশি থাকে। ওর এই ইতিবাচক আচরনে আমি এটাই শিখেছি যে, “খাট্টি হো ইয়া মিঠা
হো, লাইফ কা ইয়ে টেস্ট, জিন্দা হে হাম, জিন্দা হি রাহু, লাইফ অল দ্যা বেস্ট।“
এটাই সেই নদী
পরদিন সকাল
সকাল আমরা রওয়ানা হলাম তেতুলিয়ার উদ্দেশে। হাড়িভাসা থেকে সাইকেলে জগদল বাজার সেখান
থেকে বাসে বুড়াবুড়ি হয়ে তেতুলিয়া ডাকবাংলো। ডাকবাংলো জায়গাটা খুব সুন্দর। একটা বড়
টিলার উপর একটা পার্কের মত। ডাকবাংলোর পাশ ঘেঁষেই আছে একটা নদী। এটি থেকে
স্থানীয়রা পাথর উত্তোলন করে। কিন্তু এই নদীটি ইন্ডিয়ার সীমান্তে। সীমান্তের
কাঁটাতারের বেড়াটা নদীর অপর পাড়ে। কিছুদিন আগেই নাকি এই পাথর তোলাকে কেন্দ্র করে
বি.এস.এফ রা বেশ কিছু স্থানীয় বাংলাদেশি কে গুলি করে মেরেছে। এরপর বি.জি.বি এবং
বি.এস.এফ এর সমঝোতার মাধ্যমে বাংলাদেশি কিছু স্থানীয় মানুষ পাথর তুলে জীবিকা
নির্বাহ করছে। ডাকবাংলো ঘুরে দেখা শেষ করে আবার গাড়িতে যাত্রা শুরু হল বাংলাদেশের
একদম উত্তর প্রান্ত বাংলাবান্ধা এর উদ্দেশে। প্রায় আধঘণ্টা পর আমাদের নামিয়ে দেয়া
হল বাংলাবান্ধা বাজারে। সেখান থেকে শুরু হল হাটা। রিক্সা, ভ্যান কিছুই পেলাম না
খুঁজে। বি.জি.বি ক্যাম্প থেকে ০ পয়েন্ট প্রায় ২ কিলো। এই সারা রাস্তায় কোন গাড়ি
ঘোড়া নেই এমনকি কোন দোকান পাটও নাই। আপনি যদি সেখানে ঘুরতে যান, তবে অবশ্যই নিজস্ব
কোন বাহন বা রিজার্ভ কোন বাহন নিয়ে যাবেন। প্রচণ্ড রোদ্রে, উত্তপ্ত পিচ এর উপর
দিয়ে দুই কিলো হেটে যাওয়া যে কি অভিজ্ঞতা, তা বলে বুঝানো যাবে না। রাস্তার পাশে
কোন গাছপালার ছায়াও নেই যে আপনি একটু বসে জিরোবেন।
এই সেই উত্তপ্ত পিচ
অবশেষে
পৌঁছালাম ০ পয়েন্টে। বাংলাদেশের সর্ব উত্তরে। অন্যরকম একটা অনুভুতি কাজ করছিল।
সেখান থেকে টেকনাফের দূরত্ব প্রায় ১০৩৪ কিলোমিটার। নেপাল ৬৮ কিলোমিটার, ভুটান ৬১
কিলোমিটার। আমাদের মত আর কিছু দর্শনার্থী সেখানে ছিলেন। এর মধ্যে ঢাকা থেকে
গিয়েছিলেন মাওলানা মাহবুবুর রহমান। উনার পুরো পরিবার সহ। উনাদের কাছে থাকা
হ্যান্ডিক্যামে সীমান্ত এলাকা ভিডিও করছিলেন। এখানে আমাদের কিছু বি.জি.বি ভাই দের
সাথে পরিচিত হলাম। কেউ এসেছেন, বরিশাল থেকে, কেউ ঝিনাইদহ থেকে, কেউ গাজীপুর থেকে।
এই দেশ, দেশের সার্বভৌমত্ব, সীমান্ত রক্ষায় যারা জেগে থাকেন সবসময়। যেন এই দেশের
মানুষ ঘুমুতে পারে নিশ্চিন্তে। স্যালুট জানাই সে সকল বীর সেনানী দের।
সীমান্তের শেষ বাড়ি, এখানে একটু পানি খাওয়ার জন্য ঢুকেছিলাম
দেখা তো শেষ,
এবার ফেরার পালা, আবার এই ২ কিলো হাঁটতে হবে, এটা ভাবতেই দেখি গায়ের রক্ত কেমন হিম
হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ পাকের অশেষ রহমতে একজন মোটরসাইকেল আরোহী পেলাম। উনারা ছিলেন
দুইজন, আমরা দুইজন, অনেক অনুরোধ করার পর উনারা রাজি হলেন। মোটরসাইকেলে চারজন বসা
খুব কষ্টকর, কিন্তু কি আর করা। এছাড়া উপায় ও নাই।
সেখান থেকে
সোজা চলে এলাম পঞ্চগড় শহরে। টিকেট কনফার্ম করে, আবার রওয়ানা দিলাম হাড়িভাসার
উদ্দেশে। খবিরুল ভাইদের বাড়ি থেকে গোসল, খাওয়া দাওয়া সেরে আবার সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে
পড়লাম আমকাঁঠাল এর দিকে। আম কাঁঠাল পৌঁছে, সাকেল একটা দোকানে রেখে অটো যোগে পঞ্চগড়
শহরে। আব্বুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাত ৯ টায় ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। গাড়ির
আরামদায়ক সিটে বসতেই চোখ জড়িয়ে ঘুম চলে এলো। ছেড়ে এলাম পঞ্চগড় আর রেখে এলাম জীবনের
এই প্রথম বাংলাদেশের সর্ব উত্তরে ভ্রমন করার স্মৃতি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন