“একটি তারার
জন্ম”
--আলইমরান
(১)
আমি আগের ঠিকানায়
আছি.........
সময় করে এসো একদিন
দু’জনে কিছুক্ষণ
বসে পাশাপাশি........
গানটা শুনতে শুনতে
আনমনা হয়ে পড়ল হাসান। মনে পড়ছে কলেজ জীবনের সেই কথাগুলো। সেই প্রথম দেখা থেকে শুরু
করে। অনেককেই বলতে শুনেছে প্রথম দেখায় প্রেম, কিন্তু ওর ক্ষেত্রে তা হয়নি। শ্রাবণের
ঝর ঝর বৃষ্টির মত হঠাৎ করেই হাসানের জীবনে শ্রাবণের আগমন। হাসান এবং শ্রাবণ একই কোচিং
এ ইংরেজি পড়ত, শ্রাবণ ছিল বি.টি.ভি এনলিস্টেড আর্টিস্ট, আর হাসান খুব সাধারন একটা
ছেলে। লেডিস ডিপার্টমেন্ট এ হাসান খুব লাজুক টাইপের ছিল। কারো সাথে কথা তো দূর চোখ
মেলানোর সাহস পর্যন্ত ছিল না। সেই দিক থেকে শ্রাবণের মতো মেয়ের সাথে কথা বলার চেয়ে
চাঁদে যাওয়া ওর কাছে অনেক বেশী সহজ মনে হত। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একদিন হুট করে শ্রাবণ
কে ঘুরতে যাওয়ার দাওয়াত দিয়ে ফেলল হাসান। শ্রাবণ তো প্রথমে বিশ্বাস ই করতে পারছিল
না যে হাসান ওকে এই অফার করবে।
সেইদিনটি ছিল
ফেব্রুয়ারির ২ তারিখ। হাসান এবং শ্রাবণের জন্য স্মরণীয় দিন সেটা। শ্রাবণের আসার
কথা ছিল নীল শাড়ি পড়ে এবং হাসান নীল পাঞ্জাবী পড়ার কথা। পহেলা ফেব্রুয়ারি রাতেই
হাসান মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শ্রাবণ কে ভালবাসার কথা বলার। শ্রাবণ কে নিয়ে
একটা কবিতাও লিখেছিল সে,
ওগো প্রিয়তমা,
আজ কেন এতো সুন্দর
লাগছে তোমায়
মনে হচ্ছে যেন, আকাশ
থেকে
কোন নীল পরী নেমে
এসেছে
নেমে এসেছে আমার সামনে
আমি কি উপমা দেব
তোমায়?
তোমার তুলনা তো তুমি
নিজেই।
আজ খুব ইচ্ছে করছে
ভালবাসতে তোমায়
কিন্তু দ্বিধা সংশয়
মনে
যদি তুমি না
মান.......!!
তোমার পাশে আজ তুচ্ছ
আমি
ওগো হৃদয়ের রানী
দেবে কি তোমার হৃদয়ে
আমারে ঠাই?
নাকি মোর স্বপ্ন,
স্বপ্নলোকেই হারাবে
আজ তুমি ক্ষমতায়, আমি
বিরোধী
তবু মোর হৃদয় আসনে,
ডাকছি তোমায় ভালোবেসে।
চলে এসো এ হৃদয়ে,
শান্ত কর এ মন
কথা দাও ভুলে যাবে না
কখনও আমায়
শুধু রাখবে মনে, একজনই
ছিল তোমার
ভালবাসত শুধুই
তোমাকে।।
এর সাথে একটা ছোট্ট
চিরকুটে লিখেছিল
* **** ***
এটা আমার হৃদয় নিংড়ানো
একটা কথা তোমার জন্য। তুমি হ্যাঁ ও বলতে পার, না ও বলতে পার। বলার আগে মনে রেখ যে
“না” বললে কষ্ট পাব।
না, শ্রাবণ নীল শাড়ি
পড়ে আসেনি। হাসান নির্দিষ্ট জায়গায় দাড়িয়ে ছিল নীল পাঞ্জাবী পরে। কেন জানি ওর মনে
হচ্ছিল, এই জন্যই কি কষ্টের রঙ নীল???
(২)
কালো রঙের একটি শাড়ি
পরে শ্রাবণের আগমন, হাসান যেন চোখ ফেরাতে পারছিল না। সকালের মৃদু হাওয়ায় শাড়ির
আঁচলের সাথে উড়ছিল শ্রাবনের মেঘ কালো চুল। মুখের সেই মিষ্টি হাসি কি কটাক্ষের
ছিল?? তা এখনো জানতে পারেনি হাসান। তবে বিভোর হয়ে দেখছিল প্রানের প্রিয়তমার হেঁটে
আসা। বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারল না সে। একেবারে কাছে চলে আসায় হাসানের নাকে ভেসে
এলো খুব মিষ্টি একটা গন্ধ।
মুচকি মুচকি হাঁসতে হাঁসতে
হাসান কে জিজ্ঞেস করলো শ্রাবণ,
--কিরে কোথায় যাবি
চল.... আর এভাবে হা করে কি দেখছিস??
সম্বিত ফিরে পেয়ে
হাসানের চটজলদি উত্তর,
--তোকে না বলছিলাম নীল
শাড়ি পরে আসতে, তুই কালো শাড়ি পরে এসেছিস ক্যান???
--নীল শাড়ি কারো কাছে
পাইনি রে, এটা ছিল তাই পরে এসেছি। রাগ করিস না। চল যাই।
ওদের গন্তব্য ছিল
বাণিজ্য মেলা। মেলায় হাসানের কিছু বন্ধুর সাথে দেখা হোল যারা শ্রাবণের ও বন্ধু।
দেখা মাত্র ওদেরকে নিয়ে শুরু হোল মসকারা। কিছুক্ষণ ওদের কাছ থেকে সময় কাঁটিয়ে আবার
হাঁটতে লাগলো দুজন। গাড়িতে উঠার আগেই কবিতা আর চিরকুট শ্রাবণের হাঁতে দিয়েছিল
হাসান। কিছুক্ষণ কথা বলার এক পর্যায়ে হাসান বলল,
--কবিতা পরেছিস??
--হু
--কেমন হয়েছে??
--ভালো। তুই আমায় নিয়ে
কবিতা লিখবি তা কিন্তু আমি ভাবিনি কখনও।
--আমিও ভাবিনি। চিরকুট
টা পড়েছিস??
--হু
--কি বুঝলি??
--বুঝিনি, বুঝিয়ে দে।
-- * **** *** এর অর্থ
I love you.
--I hate you ও তো হতে পারে??
-- তা পারে। কিন্তু
যাকে নিয়ে রাত জেগে কবিতা লিখি টার ক্ষেত্রে I miss
you হতে পারে
কিন্তু hate you হওয়া কি অসম্ভব না??
--তা ঠিক।
আবার কিছুক্ষণ নিরব
থেকে হাঁটতে থাকল দুজন। হাসানের ভিতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, হয়ত শ্রাবণের ভিতরেও তাই,
কিন্তু হাসানের আর তর সইল না,
--কিরে উত্তর দিলি
না??
--কি বলবো??
--আমার চিরকুটের
উত্তর....
--এখনই দিতে হবে??
--তুই এখন দিতে না
চাইলে থাক। আর কিছুদিন ভেবে নে।
--হুম!!! আমি তো
বেশীদিন দেশে থাকব না
--কোথায় যাবি??
--ভরতন্যট্টম এবং
কত্থক নাচের এর উপর উচ্চতর প্রশিক্ষন নিতে ভারত এ চলে যাব।
--আমিও ইন্টারের পর
ক্যানাডা চলে যাব গ্রাজুয়েশন করার জন্য। ইন্টার পর্যন্ত আছিস তো??
--হুম। তা আছি।
--আয় তবে, অন্তত এই
বছরটা দুজনে চুটিয়ে প্রেম করি। পরে তুই তোর রাস্তায়, আমি আমার রাস্তায়।
এতক্ষন কথার ফাঁকে
দুজনের পাশাপাশি হাঁটার দূরত্ব একটু একটু করে কখন কমে আসছিল তা হাসান খেয়াল করে
নি। খেয়াল হোল যখন শ্রাবণের হাতের আলতো ছোঁয়ায় হাসানের সাড়া গায়ে বিদ্যুৎ খেলে
গেলো। শ্রাবণ কথার ফাঁকে আলতো করে হাসানের হাত ধরে রেখেছে। হাসান ভেবেছিল যে বলবে
“আমি তোমার হাতটা একটু ধরি??” কিন্তু এযে মেঘ না চাইতেই জল। ১০০০ ভোল্টের বিদ্যুৎ
তখন হাসানের হৃৎপিণ্ডের ভিতর দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ১০ বার যাওয়া আসা করছে। হয়তো হৃৎপিণ্ডের
ধুক ধুক শব্দ শ্রাবণ আরেকটু হলেই শুনে ফেলবে। হাসানের হাতের ফাঁকে শ্রাবণের হাত
তখন আস্তে আস্তে মিশে যাচ্ছে, একটা সময় হাসানের হাত জড়িয়ে ধরে একেবারে প্রায় বুকের
কাছে মাথা এনে হাসানের হার্টবিট থামিয়ে দেয়ার মত আবেগে শ্রাবণ বলল, “তবে তাই হোক”। ঠিক সেই মুহূর্তে
হাসানের ২ টি হার্টবিট মিস
হোল।
(৩)
পরদিন কোচিং এ যেতেই
ক্লাসের সবাই কেমন করে যেন হাসানের দিকে তাকাতে লাগলো, যেই চাহনিতে আগের সহানুভূতি
সরে গিয়ে হিংসা স্থান করে নিয়েছে। হাসানের সব বন্ধুরা এবং শ্রাবণের বান্ধবীরা
হাসান কে ঘিরে ধরলো। তাদের একটাই প্রশ্ন শ্রাবণের মত মেয়েকে তুই কি বলে ঘুরাতে
নিয়ে গেলি। আর সেখানে এমন কি হোল যার কারনে শ্রাবণ কাল সারারাত কেঁদেছে। হাসান তো আকাশ
থেকে পড়ল, বলে কি??
শ্রাবণ সারারাত
কেঁদেছে, কেন???
স্রাবণকে দেখার জন্য
হাসানের মন ছটফট করতে লাগলো। যদিও ওদের শর্তযুক্ত ভালোবাসা, কিন্তু ভালোবাসা বলে
কথা। প্রতিক্ষার পালা শেষ করে শ্রাবণ লজ্জারাঙ্গা মুখে ধীরপায়ে ক্লাসে ঢুঁকল।
হাসানের মনে অনেক প্রশ্ন জমা ছিল, কিন্তু কিছুই না বলে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে
তাকিয়ে রইল শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ এসে তার পাশে বসল। কোন সাড়া শব্দ নেই, শুধুই
দুজনার মুখ চাওয়া। বেশ কিছুক্ষণ পর হাসান নিরবতা ভাঙল,
--তুই কেঁদেছিলি
রাতে?? ক্যান??
--তাতে তোর কি?? তুই
কি বুঝবি??
--আরে কাল না আমাদের
প্রেম হোল। আমাকে তুই বলবি না ক্যান কাঁদলি।
--ও তুই বুঝবি না।
কথা আর আগে বাড়ল না। তবে হাসানের গলা কেন যেন ব্যাথা শুরু হোল, এটা কি
কান্নার লক্ষন?? ভাবল সে। কিন্তু চোখে তো পানি আসছে না, তবে মন ভার হয়ে আছে ক্যান??
কি জানি বাবা!! এটা আবার কি হচ্ছে। ভাবতে ভাবতে শ্রাবণের দিকে চোখ ফেরায় সে
চোখাচোখি হয়। কেন যেন গতকাল থেকে আজকে স্রাবণকে অনেক বেশী সুন্দর লাগছে। স্রাবণকে
সেই দিনের মত সুন্দর হাসানের কাছে আর কখনও লাগেনি।
বাসায় ফিরে ঘুমানোর
খুব চেষ্টা করছিল হাসান। এমনিতেই ও খুব ঘুমকাতুরে। ২০ মিনিট কোথাও কাজ ছাড়া বসে
থাকলে স্বয়ংক্রিয় ভাবে ঘুমিয়ে যায় সে। আজ ঘুম যেন ছুটি নিয়ে হাওয়া। ঘুমের ট্যাবলেট
খাব নাকি?? ভাবছে সে। ভাবনায় কল্পনায় খালি ভেসে উঠছে একটাই মুখচ্ছবি। চোখ বন্ধ করলেও
যা, খুললেও তা। এতো দেখি মহা বিপদ। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ফোন দিল শ্রাবণকে....
--হ্যালো শ্রাবণ?
--হু, ঘুমাসনি এখনও
--তুই ও তো ঘুমাসনি
কিছুক্ষণ নিরবতা
--তোকে মনে পড়ছে খুব।
--কালকে ক্লাসে দেখা
হবে।
--কাল তো আমার ব্যাচের
পড়া নেই,
--আমি থাকব, তুই আসিস।
কফি হাউসে তোর জন্য অপেক্ষা করব।
--ঠিক আছে।
কট করে লাইনটা কেটে
গেল। হাসান যে কত কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু ওর হ্যালো শোনার পর আর কিছুই বলতে
পারেনি। এভাবে কেটে গেলো বেশ কিছুদিন। সারাদিন আড্ডা রাতে ২/৩ মিনিট কথা। এইভাবে
ভালোই চলছিল। মাঝে মাঝে টুকটাক ঝগড়া। মোটামুটি সবাই ওদের প্রেমের কথা জেনে গেল।
যেখানেই মুরুব্বীদের কান, সেখানেই প্রেমের সমস্যা শুরু। ওদের প্রেমের বন্ধনে প্রথম
আঘাত হানল যে দিন, সে দিনটা আজো মনে পরে হাসানের। সেই রাতে হাসানের মনে হয়েছিল
প্রেম করা কি অনেক বড় অপরাধ??
(৪)
সেইদিনের পর অনেক ঝড়
বয়ে গেছে দুজনের জীবনে। অনেকবার পালিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত ও নিয়েছিল ওরা। কিন্তু
কেন যেন মনে হয়েছে, এভাবে পালিয়ে যাওয়া মানে হেরে যাওয়া, প্রেমকে, ভালোবাসা কে
অপবিত্র করা। হাসান শুধু এটাই ভাবত যে ওর ভালোবাসা যদি সত্যি এবং পবিত্র হয় তবে
পালিয়ে যাওয়ার দরকার হবে না।
দু পরিবারের রেষারেষির
সূত্র ধরে একসময় হাসান আর শ্রাবণের ভিতরেও ভুল বুঝাবুঝি শুরু হোল। ওদিকে শ্রাবণের
পরিবার বিভিন্ন স্থানে শ্রাবণের জন্য পাত্র দেখতে লাগলো। হাসানের সাথে মোটামুটি অনেকদিন কথা হয়না শ্রাবণের,
ফোন দিলেই অন্য কেউ ধরে, হাসান তার পরিচয় দিলে বকা খায়, ফোন শ্রাবণ পর্যন্ত যায়
না। এক পর্যায়ে হাসান ভাবল যে এভাবে ঝুলে না থেকে শেষ করে দেই সম্পর্ক। তখনও
পর্যন্ত হাসানের চিন্তার মধ্যেও ছিল না যে কেন এমন হচ্ছে।
শ্রাবণের দেয়া সব চিঠি
এবং উপহার একসাথে করে নিয়ে হাসান এক বিকেলে চলে যায় শ্রাবণের বাসায়। বাসার কাছে
আসতেই দেখতে পেল যে উদ্ভ্রান্তের মত শ্রাবণ একটা ডাইরি বুকে নিয়ে কোথায় যেন
যাচ্ছে। হাসান আস্তে করে ডাকল, “শ্রাবণ”। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত চমকে ওর দিকে তাকাল শ্রাবণ। যেন এক বিরান মরুভূমিতে পানির জন্য হাহাকার করা এক মরু
বেদুঈন তার মৃত্যু শয্যায় পেয়েছে এক
আঁজলা পানি। কত কথা হোল চোখে চোখে, কত জিজ্ঞাসা, এতদিন কোথায় ছিলে?? রাগ, অভিমান,
অনুরাগ এককথায় সব অনুভূতি একসাথে কয়েক মুহূর্তে নাড়া দিয়ে গেল দুজনার মনে।
“বাসায় চল” কাছে এসে
শুধু এতটুকুই বলল শ্রাবণ।
শ্রাবণ দের বাসার
সোফায় বসে দুজন অপলক শুধু তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। হঠাৎ করেই প্রচণ্ড শব্দে
বিদ্যুৎ চমকালো, এবং শুরু হল অঝোর ধারায় বৃষ্টি। বাইরে চলছে জল ছলছল বৃষ্টি, আর
দুজনের ভিতরে চলছিল কষ্ট এবং না হারিয়ে পাওয়ার কান্না ও সুখের শ্রাবণধারা। নিরবতা
ভাঙল শ্রাবণ,
--মনে পড়েনি আমাকে??
--তুমি তো অন্যের ঘরণী
হয়ে যাচ্ছ, মনে করে শুধু শুধু কষ্ট পেয়ে লাভ কি??
--এই কি তবে তোমার
ভালবাসা??
হাসানের ভিতরে যেন
ভেঙ্গে চুরে, দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। কাঁপা হাতে শ্রাবণের সব স্মৃতি বের করে ওর হাতে
তুলে দিয়ে বলল,
--এই নাও, তোমার
আমানত। আমি আর কখনও তোমাকে মনে করতে চাই না। ভয় পেয়না, কখনও আমার প্রেমের দাবি
নিয়ে ফিরে আসব না। তোমাকে সুখী দেখতে চাই। অনেক অনেক সুখী। যদি কখনও তোমার মনে হয়
যে এই আমাকে তোমার প্রয়োজন, তবে নির্দ্বিধায় চলে এস। আমার দরজা তোমার জন্য সবসময়
খোলা থাকবে। আমি তোমাকে পাওয়ার জন্য ভালবাসিনি, আমি চেয়েছি তুমি সুখী হও।
কথাগুলো একদমে বলে
থামল হাসান, ইচ্ছে হচ্ছিল শেষ বারের মত স্রাবণকে বুকে জড়িয়ে নিতে, মাথায় হাত
বুলিয়ে বলতে যে “এইত আমি, আছি, থাকব আজীবন শুধু তোমার হয়ে।“ কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে
না।
হঠাৎ শ্রাবণ ঝাঁপিয়ে
পড়ল হাসানের বুকে। অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগল। কান্নার জলের সাথে সব দ্বিধা, কষ্ট,
লজ্জা ভেসে গেলো। শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ঐ কথাগুলোই বলল হাসান। নিজের চোখের পানিও ধরে
রাখতে পারছিল না সে। একেই বোধ হয় কান্না বলে, কিন্তু একই সুখের কান্না না দুঃখের
তা সে বুঝে উঠতে পারছে না। নিজেকে ঐ মুহূর্তে সবচেয়ে অসহায় মনে হচ্ছিল তার।
(৫)
তারপর থেকে আবারও শুরু
হোল ভালবাসার ট্রেনের যাত্রা, আবার শুরু হোল লুকোচুরি প্রেম। ইতিমধ্যে হাসানের
বাবার সাথে এই নিয়ে হাসানের অনেক ঝগড়া ঝাঁটি হয়ে গেছে। একমাত্র ছেলে ভেবে হাফিজ
সাহেব ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন সেই কথা। হাসানের বন্ধুরা ওদের এই পরিণয় নিয়ে খুব
চিন্তিত হয়ে পড়ল একসময়। সবাই শুধু ভাবত যে এর ভবিষ্যৎ কি??
হাসান আর শ্রাবণের
ভালবাসা আর শর্ত যুক্ত ছিল না। অনেক অনেক সিরিয়াস পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। হাসানের
খুব ইচ্ছে ছিল প্রাইভেট ভার্সিটি তে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে, কিন্তু
হাফিজ সাহেব তাকে এক রকম জোর করেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এ ভর্তি করে দিলেন। আর শ্রাবণ
কে ওর বাবা মা পড়াশুনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু হাসান এই ব্যাপারটা মানতে নারাজ
ছিল। তাই একদিন শ্রাবণের সব কাগজপত্র নিয়ে ওর স্বাক্ষর নকল করে ওকে সোহরাওয়ার্দী
কলেজে ভর্তি ডিগ্রি তে ভর্তি করে দিয়েছিল সে।
হাসানের এই দুর্যোগ
সময়ে ওর সব বন্ধুদের সাথে সাথে ওর এক চাচাত ভাই ও অনেক উৎসাহী ছিল। একদিন হঠাৎ ওর
ফোন এল,
--ভাই,তুমি কি এমনেই
ঝুলবা,না কিছু করবা??
--আমি কি আর করমু ক??
--তুমি কইলে আমি
চেয়ারম্যান দাদারে পটাই??
--তুই পারবি?? পারলে
খারাপ হয় না।
--ঠিক আছে, তাইলে তাই
করতাছি।
হাসানের আপন দাদা
বেঁচে নেই। কিন্তু ওর আব্বার চাচা এই চেয়ারম্যান দাদা বেঁচে আছে। হাসানের আব্বু
খুব রাগী হলেও এই দাদা কে উনি খুব মানে। তাই এই দাদাকে পটাতে পারলেই কেল্লাফতে তা
হাসান ভালো করেই বুঝে।
এর কিছুদিন পর আবার
সেই চাচত ভাইয়ের ফোন,
--ভাই, দাদারে নিয়া
ঢাকা আইতাছি।
--কস কি?? কি কয়া রাজি
করালি??
--বলছি দাদা, হাসান
ভাই আর শ্রাবণ আপায় যদি কোন একদিন খুব ভোরে আপনার বাড়ির দক্ষিন দিকের গাছে ফাঁসি
লয়, তাইলে আপনার কেমুন লাগব?? আর কিছু কইতে হয় নাই, দাদায় আম্পেরে খুব আদর করে তা
তো জানেনই। সকাল বেলা থেইকা আমারে কইতাছে, চল ঢাকা যাই। হে হে হে।
হাসানের তার কান কে
বিশ্বাস করতে পারছিল না। কি করবে কিছু ভেবে না পেয়ে সে স্রাবণকে ফোন দিয়ে দেখা
করার জন্য বলল। স্রাবণকে এই কথা বলার পর ও অজ্ঞান হওয়ার মত অবস্তা। কোনরকম বলল যে
“এখন কি করব??”
ওরা দুজন মিলে বুদ্ধি
করে একটা স্বর্ণের আংটি কিনল, পর্যাপ্ত টাকা হাসানের কাছে ছিল না, শ্রাবণের কাছ
থেকে ২০০০ টাকা ধার করে আংটি কেনা হোল। স্রাবণকে রেডি হতে বলে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে
হাসান বাসায় এসে ওর দাদার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। দাদা এলে বুঝিয়ে শুনিয়ে বিকেলে
স্রাবণদের বাসায় যাওয়ার প্ল্যান করল ওরা। ওদিকে হাসানের বাবা এর কিছুই জানত না। তারপরের
ঘটনা তো ইতিহাস। দাদার সহযোগে আংটি বদল সম্পন্ন হোল। সেটি ছিল রোযার মাস। দু
পক্ষের আলোচনা সাপেক্ষে ঈদের মাসখানেক পর বিয়ের তারিখ ধার্য করা হোল। যদিও
কোনপক্ষই এ বিয়েতে খুব খুশী ছিল না, কিন্তু হাসান, শ্রাবণ, চেয়ারম্যান দাদা,
ফরিদ(হাসানের বন্ধু)এবং রোকন(হাসানের চাচত ভাই) এই কজনের সুক্ষ প্ল্যানের কাছে
উনারা অনিচ্ছা সত্তেও এ বিয়েতে রাজি হলেন। বেশ ধুমধাম করেই ওদের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল।
একেই বোধহয় বলে লাভ ম্যারেজের অ্যারেঞ্জ সংস্করণ।
দুজনের কাছেই চলে
এসেছিল সেই রাত, অনেক আকাঙ্ক্ষিত, স্বপ্নবোনা, সেই রাত। বধু বেশে শ্রাবণ আর বর
বেশে হাসান, ভাবতেই হাসানের সাড়া গায়ে শিহরণ তুলে যাচ্ছিল। বাসর ঘরে নববধূর মুখ
দেখে তন্ময় হয়ে তাকিয়েই ছিল হাসান। সেই রাতে বাহুডোরে তার স্বপ্নের রানী কে নিয়ে
আনমনে ভাবছিল হাসান, তবে কি আমরাই জয়ী হলাম????
(অসম্পূর্ন)